ক্যান্সার রোগীর লক্ষণ--টিউমার থেকে ক্যান্সার এর লক্ষণ

ক্যান্সার রোগীর লক্ষণ

ক্যান্সার একটি জটিল রোগ, এবং এর লক্ষণগুলো বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের জন্য ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে যে, এই লক্ষণগুলো অন্য সাধারণ রোগের কারণেও হতে পারে, তাই আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।

ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:

  • অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস: কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে দ্রুত ওজন কমে যাওয়া ক্যান্সারের একটি অন্যতম লক্ষণ। 
  • অব্যক্ত ক্লান্তি বা অবসাদ: দীর্ঘস্থায়ী ও অস্বাভাবিক ক্লান্তি যা বিশ্রাম নেওয়ার পরেও যায় না, তা অনেক ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে (যেমন: লিউকেমিয়া, কোলন ক্যান্সার)। 
  • শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক মাংসপিণ্ড বা চাকা: যদি শরীরের কোনো স্থানে নতুন করে মাংসপিণ্ড বা চাকার মতো কিছু দেখা যায়, বা পুরানো কোনো চাকার আকৃতি বা আকার পরিবর্তন হয়, তবে তা পরীক্ষা করানো উচিত। 
  • দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ভাঙা: যদি দীর্ঘ সময় ধরে কাশি থাকে যা সাধারণ ওষুধেও ভালো হয় না, বা গলার স্বর পরিবর্তন হয়, তবে এটি ফুসফুস বা গলার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 
  • অস্বাভাবিক রক্তপাত: শরীরের কোনো অংশ থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া, যেমন: মল বা মূত্রের সাথে রক্ত যাওয়া, যোনিপথ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, বা কাশির সাথে রক্ত আসা, তা ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 
  • ত্বকের পরিবর্তন: ত্বকের কোনো তিল বা আঁচিলের আকার, আকৃতি বা রঙে পরিবর্তন, নতুন কোনো দাগ বা ক্ষত যা সহজে সারে না, তা ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 
  • মলত্যাগে পরিবর্তন: কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ায় হঠাৎ পরিবর্তন, যা দীর্ঘদিন ধরে থাকে, বা মলের সাথে রক্ত যাওয়া কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • গিলতে অসুবিধা: খাবার গিলতে বা ঢোক গিলতে ব্যথা বা অসুবিধা খাদ্যনালীর ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 
  • দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা: শরীরের কোনো অংশে দীর্ঘদিন ধরে অব্যক্ত ব্যথা থাকা যা সাধারণ ওষুধেও কমে না। ব্যথার অবস্থান অনুযায়ী এটি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 
  • ঘন ঘন জ্বর বা সংক্রমণ: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে ঘন ঘন জ্বর আসা বা সংক্রমণ হওয়া রক্তের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে তা চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

টিউমার থেকে ক্যান্সার এর লক্ষণ

 টিউমার মানেই ক্যান্সার নয়। টিউমার হলো শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি, যা একটি মাংসপিণ্ড বা চাকার মতো দেখায়। সব টিউমারই ক্যান্সার নয়। টিউমার দুই ধরনের হতে পারে:

বেনাইন (Benign) টিউমার: এই ধরনের টিউমার ক্যান্সারবিহীন। এরা সাধারণত ধীরে ধীরে বাড়ে, আশেপাশের টিস্যুতে ছড়ায় না এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে যায় না। এগুলো সাধারণত জীবন-হুমকির কারণ হয় না।
ম্যালিগন্যান্ট (Malignant) টিউমার: এই ধরনের টিউমারই হলো ক্যান্সার। এরা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, আশেপাশের টিস্যু আক্রমণ করে এবং রক্তের মাধ্যমে বা লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের মাধ্যমে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে মেটাস্ট্যাসিস বলা হয়।

যদি কোনো টিউমার ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয় বা ম্যালিগন্যান্ট হয়, তাহলে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলো টিউমারের অবস্থান এবং কোন ধরনের ক্যান্সার হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে যা দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:

টিউমার থেকে ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ:

অস্বাভাবিক বৃদ্ধি: যদি কোনো টিউমারের আকার বা আকৃতি দ্রুত পরিবর্তন হয়, তাহলে তা ম্যালিগন্যান্ট হওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
অব্যক্ত ওজন হ্রাস: কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া ক্যান্সারের একটি সাধারণ লক্ষণ।
অস্বাভাবিক ক্লান্তি: দীর্ঘস্থায়ী ও অস্বাভাবিক ক্লান্তি বা অবসাদ যা বিশ্রাম নেওয়ার পরেও যায় না।
ব্যথা: টিউমার থেকে দীর্ঘস্থায়ী বা তীব্র ব্যথা, যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
ত্বকের পরিবর্তন: টিউমারের উপরের ত্বকে লালচে ভাব, দাগ, চুলকানি বা রঙের পরিবর্তন দেখা দেওয়া।
ক্ষত যা সহজে সারে না: যদি শরীরের কোনো স্থানে ক্ষত বা ঘা হয় এবং তা দীর্ঘদিন ধরে না সারে, তবে তা একটি ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।
অস্বাভাবিক রক্তপাত: শরীরের কোনো অংশ থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া (যেমন: মল বা মূত্রের সাথে রক্ত যাওয়া, অস্বাভাবিক যোনিপথের রক্তপাত)।
গিলতে অসুবিধা: ঢোক গিলতে ব্যথা বা অসুবিধা খাদ্যনালীর ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: উপরের লক্ষণগুলো অন্য অনেক সাধারণ রোগের কারণেও হতে পারে। তাই এই লক্ষণগুলো দেখা দিলেই যে ক্যান্সার হয়েছে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তবে যদি এই ধরনের কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দীর্ঘদিন ধরে থাকে বা আপনার সন্দেহ হয়, তবে দ্রুত একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি। সময়মতো রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ক্যান্সার কি ভাল হয় ?

ক্যান্সার কি সম্পূর্ণ ভালো হয়, এই প্রশ্নের উত্তরটি নির্ভর করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর:

ক্যান্সারের ধরণ: ২০০-র বেশি ধরনের ক্যান্সার রয়েছে এবং প্রতিটি ক্যান্সারের চিকিৎসা ও ফলাফল ভিন্ন। কিছু ধরনের ক্যান্সার, যেমন কিছু প্রাথমিক পর্যায়ের স্তন ক্যান্সার, ত্বক ক্যান্সার, বা প্রোস্টেট ক্যান্সার, সফলভাবে নিরাময়যোগ্য।
ক্যান্সারের পর্যায় (Stage): ক্যান্সার যত দ্রুত ধরা পড়ে, চিকিৎসার সাফল্যের হার তত বেশি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে (Stage 1 বা 2) যখন ক্যান্সার শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে না (মেটাস্ট্যাসিস), তখন চিকিৎসা করে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। কিন্তু যদি ক্যান্সার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে (Stage 4), তখন নিরাময়ের সম্ভাবনা কমে যায়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসার মূল লক্ষ্য থাকে রোগীর জীবনকাল দীর্ঘ করা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।
চিকিৎসার পদ্ধতি: বর্তমানে ক্যান্সারের চিকিৎসায় অনেক আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা রোগের নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকর। কিছু প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হলো:
সার্জারি (Surgery): যদি ক্যান্সার একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকে, তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমার এবং তার আশেপাশের কিছু টিস্যু অপসারণ করা হয়।
কেমোথেরাপি (Chemotherapy): শক্তিশালী ওষুধের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করা হয়।
রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation Therapy): উচ্চ শক্তির বিকিরণ ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে নষ্ট করা হয়।
ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy): এটি শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ করে।
টার্গেটেড থেরাপি (Targeted Therapy): এটি এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষের নির্দিষ্ট দুর্বলতাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে, ফলে সুস্থ কোষগুলোর ক্ষতি কম হয়।
হরমোন থেরাপি (Hormone Therapy): কিছু ক্যান্সার হরমোনের উপর নির্ভর করে বৃদ্ধি পায়, যেমন স্তন বা প্রোস্টেট ক্যান্সার। এই ধরনের ক্যান্সারের জন্য হরমোন থেরাপি ব্যবহার করা হয়।
রোগীর শারীরিক অবস্থা: রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য, বয়স এবং অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা আছে কিনা, তার উপরও চিকিৎসার ফলাফল নির্ভর করে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে:

আগেকার দিনে ক্যান্সার মানেই মৃত্যু বলে একটি ধারণা প্রচলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। বহু ক্ষেত্রে ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব, বিশেষ করে যদি তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করা। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সচেতনতা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

Comments